কিয়েশলফস্কি – পরিযায়ী পরিচালক

মিকোলাই জাজদন : পরিযায়ী চিত্রপরিচালক কিয়েশলফস্কি

 মৃত্যুর আগে তাঁর শেষ গণসংযোগ সভায় ক্রিস্তফ কিয়েশলফস্কি বলেছিলেন, ‘আমি মনে করি আমরা  এরকমই। আমরা জানি লক্ষ্য কোথায় এবং সেখানে পৌঁছানো সহজ পথের মতো আকর্ষণীয় নয়। ব্যাপারটা  কৌতূহল জাগায়। আমি মনে করি  চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও একই রকম, ঠিক অন্য যেকোনো কিছুর মতো…’

.

ক্রিস্তফ কিয়েশলফস্কির জীবন শুরু হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের উত্তাল সময়ে। তিনি ১৯৪১ সালের ২৭ জুন জার্মান-অধিকৃত ওয়ারশতে জন্মগ্রহণ করেন। এর পরেই, তার বাবা-মা পোল্যান্ডের পূর্ব সীমান্তবর্তী অঞ্চলে চলে যান (এখন জায়গাটা  ইউক্রেন রাজ্যে)।কিয়েশলফস্কির অভিবাসন যুদ্ধের পরেও অব্যাহত ছিল: দক্ষিণ পোল্যান্ডের শহর থেকে শহরে চলে যেতে হতো, কারণ তাঁর বাবা যক্ষ্মা রোগের জন্য চিকিৎসার জন্য বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হতেন ।

.

১৯৫৭ সালে, তিনি স্টেট টেকনিক্যাল থিয়েটার এডুকেশনাল হাই স্কুলে পড়ার জন্য ওয়ারশতে চলে যান। ১৯৬৪ সালে তিনি লোডজের বিখ্যাত লিওন শিলার ন্যাশনাল ফিল্ম, টেলিভিশন এবং থিয়েটার স্কুলে ভর্তি হন।সেখানে তিনি চলচ্চিত্র পরিচালনা বিভাগে পড়াশুনা করেন।কমিউনিস্ট আমলে বেশিরভাগ পোল্যাণ্ডনিবাসীর মতো, কিয়েশলফস্কি বহু বছর ধরে বিদেশে যাবার অনুমতি পাননি, কিন্তু, একজন চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে, তিনি তাঁর ডকুমেন্টারি ফিল্ম নিয়ে গবেষণা করে পোল্যান্ডের নানা এলাকায় যেতে পেরেছিলেন।

.

ওয়ারশ-র ডকুমেন্টারি ফিল্ম স্টুডিওর কিয়েশলফস্কি এবং অন্য পরিচালকরা ১৯৬০, ১৯৭০ এবং ১৯৮০-র দশকের পোল্যান্ডকে চিত্রিত করার উদ্দেশ্যে ছোটো ছোটো ফিল্ম তৈরি করতেন, যেমন ফ্যাব্রিকা (ফ্যাক্টরি), স্জপিটাল (হাসপাতাল) এবং ডোয়ার্জেক (স্টেশন) এর মতো  ফিল্ম তৈরি করেছিলেন। প্রতিটি ফিল্ম একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর লোকেদের নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তবে একইসঙ্গে  পোল্যান্ডের আরও সাধারণ জনজীবনও তুলে ধরেছিল।যদিও কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের সেন্সরশিপের ফলে কিয়েশলফস্কি তাঁর কাজে সীমাবদ্ধ ছিলেন, তিনি তাঁর ডকুমেন্টারিগুলোতে সত্যিকারের পোল্যান্ডকে বর্ণনা করতে চাইতেন। তার সংক্ষিপ্ত বাস্তবতাভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো বাস্তবতার সত্য চিত্রণ হিসেবে  রূপক এবং ইঙ্গিত দিয়ে তৈরি।

.

১৯৮১ সালে কিয়েশলফস্কির দুটি চলচ্চিত্র: প্রজিপাডেক (ব্লাইন্ড চান্স, ১৯৮১) এবং ক্রোটকি ডিজিন প্র্যাসি (শর্ট ওয়ার্কিং ডে, ১৯৮১), কমিউনিস্ট পার্টি এবং আন্ডারগ্রাউন্ড বিরোধীদের মধ্যে সংঘর্ষকে আরও খোলামেলাভাবে দেখায় যার ফলে রাষ্ট্রের সেন্সরশিপ ফিল্মগুলোকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। দুটি চলচ্চিত্রই পোল্যান্ডকে সেই পরিবেশে উপস্থাপন করে যখন সলিডারিটি আন্দোলনের জন্ম হয়, একটিতে ১৯৮০ সালের আগস্টে গডানস্ক শিপইয়ার্ডে বিখ্যাত ধর্মঘটের সময় লেচ ওয়ালেনসার আর্কাইভাল ফিল্ম দেখানো হয়। ১৯৮৫ এর ফিল্ম বেজ কঙ্কা (নো এন্ড) কিয়েশলফস্কির ফিল্ম ক্যারিয়ারের একটি বাঁকবদল ছিল। স্ক্রিপ্টটি লিখেছেন কিয়েশলফস্কি নিজে এবং ক্রিস্তফ পিসিউইচ, যিনি ছিলেন আইনজীবী এবং পরে রাজনীতিবিদ। এটি ছিল তাঁদের প্রথম  সহযোগিতার কাজ। দুজনের এই জুটি তাঁদের পরবর্তী সমস্ত চলচ্চিত্রে অব্যাহত ছিল।একইভাবে, প্রিজনার কিয়েশলফস্কির পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলির জন্য সঙ্গীত দিয়েছিলেন। চিত্রগ্রাহক পিয়োতর কোয়াতকোস্কি কিয়েশলফস্কির প্রথম দিকের দুটি ডকুমেন্টারিতে কাজ করেছিলেন এবং বহু বছর পর ফিরে যান, ‘থ্রি কালার’ ফিল্ম ট্রিলজিতে সুর দেবার জন্য।

.

১৯৮১ সালে পোল্যান্ডে মার্শাল ল প্রবর্তনের কথা উল্লেখ করে, ‘নো এন্ড’ ফিল্মটি একজন আইনজীবীর মৃত্যুর পরের ঘটনা বর্ণনা করে, যার স্ত্রী তার ক্ষতি পূরণের জন্য সংগ্রাম করতে থাকে।। তখন আইনজীবীর শেষ মক্কেল বন্দী ছিলেন।ছবিটি ১৯৮৫ সালে মুক্তির সময় কর্তৃপক্ষ, লুকিয়ে-থাকা বিরোধী দল এবং ক্যাথলিক চার্চ দ্বারা সমালোচিত হয়েছিল, কিন্তু আজ এই ফিল্মটা কিয়েশলফস্কির সবচেয়ে শক্তিশালী অর্জনগুলির মধ্যে একটি হিসাবে বিবেচিত হয়।লিছুকাল পরে, কিয়েস্লোস্কি ( টেন কমাণ্ডমেন্টস ) দশটি আদেশ দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে টেলিভিশন চলচ্চিত্রের একটি সিরিজ তৈরি করেন। তিনি সিনেমার জন্য দুটি পর্বের দীর্ঘ সংস্করণও তৈরি করেন – A Short Film About Killing, ১৯৮৮ এবং A Short Film About Love, ১৯৮৮। এই চলচ্চিত্রগুলি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করে এবং একজন স্থানীয় চলচ্চিত্র পরিচালক থেকে তিনি  বিশ্ব সিনেমার অগ্রগণ্য পরিচালকে রূপান্তরিত হন।

.

কিয়েশলফস্কির জীবনের এই নতুন সময়টি তার আন্তর্জাতিক কর্মজীবন দ্বারা চিহ্নিত  – বিশ্বজুড়ে ভ্রমণ, উৎসব থেকে উৎসবে যোগদান ইত্যাদি। ১৯৮৮ এবং ১৯৮৯ সালে, তার চলচ্চিত্রগুলির সাথে, তিনি ইউরোপ, উত্তর এবং দক্ষিণ আমেরিকার অনুষ্ঠানগুলোতে যোগ দেন এবং বিভিন্ন ফিল্ম ও দৈনিক পত্রিকার প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎকার দেন । তিনি হয়ে ওঠেন এক ধরনের পরিযায়ী চলচ্চিত্র নির্মাতা।  তাঁর পরবর্তী চলচ্চিত্রগুলি ছিল আন্তর্জাতিক প্রযোজনা, যেখানে তাঁর আগ্রহবিন্দু ছিল ইউরোপীয় সমাজ পর্যবেক্ষণ। ১৯৮৯ সালে কমিউনিজমের চূড়ান্ত পতনের পর, কিয়েশলফস্কি যে চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন সেগুলোতে দেখানো হয়েছিল কীভাবে পূর্ব এবং পশ্চিমের ইউরোপীয়রা   যুদ্ধোত্তর ইতিহাসে বিভিন্ন অভিজ্ঞতা থাকা সত্ত্বেও  একত্রিত বসবাস করতে পারে। 

.

কিয়েশলফস্কির ফিচার ফিল্ম তিনটি রঙের ট্রিলজি দিয়ে সম্পন্ন হয়েছিল: ‘নীল, সাদা এবং লাল’ (১৯৯৩- ১৯৯৪)। চলচ্চিত্রগুলির শিরোনাম ফরাসি পতাকার রঙ এবং ফরাসি বিপ্লবের স্বাধীনতা, সমতা ও ভ্রাতৃত্বের স্লোগানকে নির্দেশ করে। চলচ্চিত্রগুলি প্রশ্ন করে: বিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে স্বাধীনতা, সাম্য এবং ভ্রাতৃত্ব ঠিক কী? প্রতিটি চলচ্চিত্র একটি ভিন্ন ইউরোপীয় দেশের পটভূমিতে তৈরি: ফ্রান্সে নীল, পোল্যান্ডে সাদা (এবং ফ্রান্সে) এবং সুইজারল্যান্ডে লাল, প্রতিটিতে তিনজন ফরাসি অভিনেত্রী অভিনয় করেছিলেন। একদিক থেকে দেখলে, ফিল্মগুলো, অরাজনৈতিক এবং অন্তরঙ্গ গল্পের পুরো ট্রিলজি ইউরোপের একীকরণের কথা বলে। কিয়েশলফস্কির তিন রঙের ট্রিলজি একটি দুর্দান্ত আন্তর্জাতিক সাফল্য ছিল। ভেনিস ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে ‘নীল’ ফিল্মটি তাঁকে গোল্ডেন লায়ন জিতিয়েছে এবং ‘হোয়াইট’-এর জন্য বার্লিনালে সিলভার বিয়ারে ভূষিত হয়েছিলেন। ‘রেড’ তিনটি বিভাগে একাডেমি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছিল: সেরা পরিচালনা, চিত্রনাট্য এবং সিনেমাটোগ্রাফির জন্য।

.

১৯৯৩ সালে কিয়েশলফস্কি ঘোষণা করেন যে তিনি পরিচালনা থেকে অবসর নেবেন। ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে হৃদযন্ত্রের অস্ত্রোপচারের পর তিনি মারা যান। তার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়, পোলিশ দার্শনিক এবং যাজক, প্রফেসর জোসেফ টিসনার বলেন: “অন্যান্য শিল্পীরা যখন  মানুষের মধ্যস্হতা করেছেন, তখন তিনি মানুষের নিজের অন্তরজগতে প্রবেশপথের মধ্যস্থতা করেছিলেন।”

About anubadak

আমি একজন অনুবাদক । এতাবৎ রেঁবো, বদল্যার, ককতো, জারা, সঁদরা, দালি, গিন্সবার্গ, লোরকা, ম্যানদেলস্টাম, আখমাতোভা, মায়াকভস্কি, নেরুদা, ফেরলিংঘেট্টি প্রমুখ অনুবাদ করেছি ।
This entry was posted in Uncategorized. Bookmark the permalink.

এখানে আপনার মন্তব্য রেখে যান