ক্রিস্তফ কিয়েশলফস্কির জগত: একটি বিরোধী সমালোচনা : ডার্ক লয়ার্ট
প্রথমে আসে ইমেজ। ইমেজের গুণমান? কুশ্রী, নৃশংস, নোংরা, মোটাদাগের, সরাসরি। এগুলো দুর্বল সিনেমা, দ্রুত তৈরি করা হয়েছে, বেশি টাকাকড়ি ছাড়াই কিন্তু এমন দুর্বিনয়ের সাথে আমাদের বছরের পর বছর চোখে পড়েনি। পোল্যাণ্ডের কিয়েশলফস্কির সিনেমাটিক নিন্দাবাদ আমাকে খুব নাড়া দেয়।
.
কিয়েশলফস্কির চলচ্চিত্রগুলি এমন যা লাগাতার চিন্তা করে তৈরি হয়নি: মুহূর্তের স্ফুরণকে স্থান দেওয়া হয়েছে, সেই সঙ্গে খারাপ পছন্দের ঝুঁকিও। তিনি গ্রটেস্ক বোধকে স্টাইলাইজ না করেই নিজের অনুভূতির খেলা খেলেন। তিনি যা কিছু করেন তার মধ্যে তাঁকে পরিশীলিতের তুলনায়বেশি আদিম মনে হয়।
.
হঠাৎ আমি লক্ষ্য করলাম যে গত এক দশকে আমাকে কী ব্যাপার সিনেমা থেকে দূরে রেখেছিল: সেই বিবেকপূর্ণ পরিপূর্ণতা, নিজের কাছে নিজেকে নির্বোধ মনে করার ভয়, প্রযুক্তিগতভাবে ভাল ছবির আবদ্ধতা, বর্ণনার সম্ভাবনার আড়ালে, গুরুতর বিনোদনের ডাবল স্ট্যাণ্ডার্ডের আড়ালে।
.
চলচ্চিত্র নির্মাতা তাঁর চলচ্চিত্রে বেঁচে থাকেন। তাঁর সিদ্ধান্তগুলি নিখুঁতভাবে একটি বিদ্যায়তনিক আদর্শকে অনুসরণ করে না । তবে তিনি যা বলতে চান তা নির্বিঘ্নে অনুসরণ করেন। এতে চাষাড়েপনা নেই, জনসাধারণকে বোকা বানানো নেই বা অত্যধিক প্রকৃতিবাদ নেই, তা বলা যাবে না। তবে চলচ্চিত্র এই সমস্ত কিছুকে ভেজালহীনভাবে বেছে নেয়। আর আমি দুহাত দিয়ে টেনে তা আমার চোখের সামনে নিয়ে আসি, যে চোখদুটো লোভী হয়ে ওঠে। আমি কত বছর পর এই ধরনের প্রাণপূর্ণ ইমেজগুলো দেখেছি?
.
দশটি আদেশ ( টেন কমাণ্ডমেন্টস) সম্পর্কে সিরিজের চলচ্চিত্রগুলি প্রকৃতপক্ষে আদেশ/নিষেধের একটি আধুনিক ভাষ্য নয়। চলচ্চিত্র নির্মাতা শুধুমাত্র তাঁর থিম হিসাবে কমাণ্ডমেন্টসগুলো যা নির্দেশ করে তেমন বিষয়কে বেছে নিয়েছেন। এই প্রক্রিয়ায়, চলচ্চিত্রের মধ্যে দারুণ অনৈতিক বিকৃতি ঢুকে পড়ে: তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন, তিনি আমাদের জিজ্ঞাসা করেন, ওই আচরণবিধিগুলোর উদ্দেশ্য কী হতে পারে।
.
.তিনি এর একটি সংজ্ঞা খুঁজছেন: “হত্যা” কী? “ইচ্ছা” কি? তিনি প্রক্রিয়াটি প্রদর্শন করার জন্য একটি পরীক্ষামূলক চিন্তামঞ্চ ব্যবহার করেন: একটি খুন এইভাবে ঘটে, তাকে জাঁকালো বা আনুষ্ঠানিক করা হয়, ইচ্ছাকৃতভাবে বা তা ছাড়াই, তবে যে কোনও ক্ষেত্রেই ব্যাপারটা কষ্টকর। “আকাঙ্ক্ষা” হল “প্রতিবেশীর” প্রতি একটি অসামান্য এবং একপেশে আগ্রহ – সময়নিষ্ঠ বা ধ্রুবক, নিয়ন্ত্রিত বা বড়ো হয়ে ওঠা, এটি যে কোনও ক্ষেত্রেই “কষ্টকর”।
.
কষ্টকর ব্যাপারটা এই সামগ্রিক নির্মাণের একটি প্রধান থিম। যারা অবিলম্বে এটা অনুভব করতে পারে না, তারা তাঁর চলচ্চিত্রগুলিকে শ্রমসাধ্য বলে। কিন্তু কত সুন্দর, যেমন ধরুন, প্রাথমিক পরিস্থিতির শিক্ষামূলক ব্যাখ্যা! এর প্রত্যক্ষভাব এবং সরলতা – ‘রিয়ার উইন্ডো’র সিম্ফোনিক সূক্ষ্মতার সাথে তুলনা করলে – হয়ে ওঠে ক্লিনিকাল ভয়াবহতার ভিত্তি।
.
ঘটনাক্রমে, একটি পরিস্থিতির শ্রমসাধ্য, অত্যধিক স্পষ্ট নির্মাণ একই সাথে চিত্রটিতে যা দেখা যায় তার বৈশিষ্ট্যের দ্বারা সংক্ষিপ্ত এবং তীক্ষ্ণ হয়ে ওঠে।লোকেশানের জন্য পর্যাপ্ত টাকাকড়ি যোগাড় হয়নি । চারপাশে বস্তুগত বিশ্বের থেকে ছোটখাটো ছোঁয়া। ছেলেটির বৈদ্যুতিক ওয়াটার হিটার একটা অশোভন জিনিস হিসাবে ব্যবহৃত। রাস্তার ওপারের মহিলার নামহীন ট্যাপেস্ট্রি তার অশ্লীল বস্তু।
.
কখনও কখনও চলচ্চিত্র নির্মাতা পূর্ব ইউরোপীয় চলচ্চিত্র ঐতিহ্যের একটি ন্যূনতম গ্রহণযোগ্য কৌশল অবলম্বন করেন। তা হলো প্রতীকবাদ। ঘনীভূত করা, লুকিয়ে রাখা, স্পষ্ট করা, রূপকভাবে এটিকে স্থানান্তরিত করার প্রয়াস, নিজেই সেন্সরিং করার পরও বার্তা পৌঁছে দেবার তাগিদ দেখা যায়। এই পদ্ধতির ভণ্ডামি, এর মরিয়া প্রাদেশিকতা লোকেরা তো অনুভব করবেই।
.
চলচ্চিত্র নির্মাতাকে তার সমস্ত শক্তি প্রয়োগ এ-থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিল, তবে তিনি একটি জিনিস ধরে রেখেছিলেন। তা হলো চরিত্রগুলোর সরলীকৃত রূপের অনুভূতি, তাদের ক্রিয়াকলাপ, সংলাপ, পারস্পরিক সম্পর্ক। তবুও চরিত্রগুলো প্রতীকবাদী সেটপিস নয় (১৯৭০-এর দশকের হাঙ্গেরিয়ান এবং চেক ফিল্মগুলোর কথা মনে করুন)। তাদের উপাদানের গুণমান, তাদের বস্তুবাদী পক্ষপাতিত্ব তার জন্য খুবই বৈপ্লবিক ।
.
বিশেষ করে বিস্ময়কর এখানে পুরুষ চরিত্রগুলোর জন্য অভিনেতা বাছাইয়ের কৌশল: সৌকুমার্যহীন, কৃষকের মতো বিশ্রী, অস্বাভাবিক মোটা, ভীতিকরভাবে অনাকর্ষক। অন্যদিকে, নারী চরিত্রগুলো নিশ্চিতভাবে সুন্দর এবং সংবেদনশীল, তবে চলচ্চিত্রটি তাদের কেন্দ্র করে নয়, যদিও পুরুষ চরিত্রগুলো তাদের আশেপাশে ঘোরে। পুরুষ প্রট্যাগনিস্টের ওপর নির্ভর করার একটি ইমেজ তৈরি । এটা পুরুষালি, নারীবিদ্বেষী সিনেমা।
.
আমি চলাফেরার তুচ্ছতা পছন্দ করি: যেমন ক্যামেরার আকস্মিক, আশ্চর্যজনক বাঁক, কাটা-জোড়া, দেখার কোণ, বর্ণনামূলক নির্মাণ। কোন প্রস্তুতি ছাড়া, কিন্তু হঠাৎ দেখা মেলে আছে: টুকরাটির বৌদ্ধিক পাটাতনে সুস্পষ্ট এবং নিখুঁত। কর্মকাণ্ডের কোনও দুর্দান্ত অনুরণন নেই। যেমন ধরুন, যে দৃশ্যে যুবকটি দুধের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ফিল্মটা তার সাথে এগোচ্ছে। পরম গতিবিদ্যার এক মুহূর্ত। যেখানে এটি গভীর বিরোধী-আবেগে দেখানো হচ্ছে।
.
আবেগের একটি গূঢ় অবিশ্বাস কিয়েশলফস্কির তত্ত্বের ওপর ঘোরাফেরা করে। চরিত্রগুলোকে যে আবেগ ধরে রাখে তা বাইরে থেকে দেখা। রাস্তার ওপার থেকে দেখা যুবক এবং যুবতীর মধ্যে প্রথম কামোত্তেজক সাক্ষাতের চেয়ে আরও অনুপযুক্ত, মারাত্মক, হাস্যকর দৃশ্য কেউ কল্পনা করতে পারেন? এটা প্রেম সম্পর্কে ফ্লবেয়ারের সেই বিখ্যাত বাক্যাংশগুলির মধ্যে একটির মতো: “এন ফুমান্ট আন সিগারে” [ সিগারেট ফোঁকা সময়]।
.
এই ফিল্মগুলো যা সহজ তার বিপরীত; ফিল্মগুলো অত্যন্ত আলাদা উচ্চাকাঙ্ক্ষা আর সম্ভাবনার একটি ভঙ্গুর এবং অস্থির ফলাফল। চলচ্চিত্র নির্মাতা একই সাথে বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলেছেন, বিভিন্ন বাধায় ভুগছেন, প্রাদেশিকতা এবং সার্বজনীনতার মধ্যে দোল খাচ্ছেন, প্রাদেশিক মূল্যবোধের একটি শ্বাসরুদ্ধকর অনুভূতি এবং বিশুদ্ধ, ফালতু আঙ্গিকের মাধ্যমে কাহিনী থেকে পালানোর ইচ্ছা ব্যক্ত করেছেন। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল যে এই দূরের বহিরাগত ফিল্মগুলো এই মুহূর্তে ইউরোপে আমাদের জীবন কেমন তা নির্বিঘ্নে আকার দেয় আর আমরা সেসব নিয়ে কী ভাবি তা জানায় ।